বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের দুই প্রজন্মের গর্ব—পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও তাঁর ছেলে বাপ্পা মজুমদার। দুজনেরই সংগীতে অবদানের ইতিহাস দীর্ঘ ও গৌরবময়। সেই গর্বের ছায়ায় আজকের দিনে স্মরণ করা হচ্ছে পরিবারের এক নিবেদিতপ্রাণ সদস্যকে—ইলা মজুমদারকে। আজ ৩ মে, তাঁর ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।
এই দিনে মাকে স্মরণ করে আবেগভেজা স্মৃতিচারণ করেছেন সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি তুলে ধরেন এক করুণ রাতের গল্প, যেদিন তাদের পরিবার সংগীত কলেজ থেকে উৎখাত হয়েছিল।
বাপ্পা লিখেছেন, ‘আমার ছোটবেলার সেই প্রিয় মিউজিক কলেজ থেকে যেদিন আমাদের ফিল্মি স্টাইলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল, সেই দিনটি আজও চোখে ভাসে। বাবা তখন কলেজের দোতলায়, এলোমেলো চুল, পরিচিত কোট নেই, গলায় ঝোলানো টাই… চিৎকার করে বলছেন, “তোমরা যাও… আমি আসছি…” আমি তখন সদ্য নার্সারির ছাত্র। এক রিকশায় আমাদের তুলে দেওয়া হলো। আর মা, চোখে কান্না চেপে তাকিয়ে আছেন বাবার দিকে। একে একে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে আমাদের আসবাবপত্র। আমরা এক রাতেই হয়ে গেলাম বাস্তুহারা।’
উল্লেখ্য, দেশের একমাত্র সংগীত কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বারীণ মজুমদার। ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করে কলেজটি, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হয় এবং অবশেষে ১৯৯২ সালের শেষ দিকে আগারগাঁওয়ে নিজস্ব জমিতে ফিরে আসে।
সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্ছেদের পর মগবাজারে এক ভাড়াবাড়িতে নতুন জীবন শুরু করেন বারীণ মজুমদারের পরিবার। মেজ ভাই, ফারুক কাকু ও বাবার কিছু ছাত্রের সহযোগিতায় পাওয়া সেই আশ্রয়ও ছিল সাময়িক।
কিন্তু দুর্দশা আরও বাড়ে, যখন বারীণ মজুমদার মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। বাপ্পা লিখেছেন, ‘বাবা বাসায় ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রেপ্তার হলেন। ফিরলেন ১৮ দিন পর। তখন তিনি মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন।’
এই দুঃসময়ে পরিবারের হাল ধরেন ইলা মজুমদার। বাপ্পা তাঁর মাকে বর্ণনা করেছেন এক অতিমানবী হিসেবে। ‘মা দুর্গার মতো এগিয়ে এলেন। সংসার রক্ষায় লড়াই শুরু করলেন। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে চাকরি নিলেন। আমাদের টিকিয়ে রাখলেন। আজ আমি যদি কিছু হতে পারি, তার কৃতিত্ব শুধুই আমার মায়ের। তিনি শুধু স্ত্রী বা মা নন, তিনি এক উদাহরণ। একজন সত্যিকারের “সুপার হিউম্যান”। আমি গর্ব করে বলি—আমি ইলা মজুমদারের ছেলে।’
বর্তমানে বাপ্পা মজুমদার কানাডায় রয়েছেন এবং সেখানে কয়েকটি স্টেজ শো ও কনসার্টে অংশ নিচ্ছেন। তবে দূরদেশে থেকেও তিনি ভুলেননি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণাকে—মা ইলা মজুমদারকে।
এই স্মরণ যেন কেবল এক মা’কে শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং প্রতিটি সংগ্রামী নারীর প্রতি এক গভীর সম্মান।