রাজনৈতিক নাকি মানসিক ‘দহন’

সময়টা ২০১৪ সালের শেষ ভাগ— পুরো দেশে অবরোধ চলছে। মানুষ বাস-লেগুনাতে উঠতে ভয় পেত। সবার মনে এক আতংক বিরাজমান— যার নাম পেট্রোল বোমা। আমার সময়টা খুব ভালোভাবে মনে আছে কারণ আমার ভার্সিটির বাস অফ ছিল কিন্তু ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। তাই পরীক্ষা দিতে যেতেই হবে। এজন্য অনেক ভোরে উঠে ক্যাম্পাসে চলে যেতাম আর জানালার কাছের সিটে বসতাম। যদি পেট্রোল বোমা ছুড়ে দেয় তাহলে যেন জানালা দিয়ে টুপ করেই লাফ দিতে পারি।

ভয়ংকর এ বিভীষিকার যারা শিকার হয়েছে তারাই জানে এর ভয়াবহতা। প্রতিদিন এত লোক হামলার শিকার হতো যে বার্ন ইউনিটে তাদের ঠাঁই দেওয়া অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এরকম স্পর্শকাতর ইস্যুটি পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন পরিচালক রায়হান রাফি তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘দহন’-এ।

‘পোড়ামন ২’ ও ‘দহন’র রাফির মধ্যে বেশ ভালো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। আমার মতে এটি তার এক্সপেরিমেন্টাল চলচ্চিত্র। কারণ গতানুগতিক ধারার থেকে বের হয়ে একটু আলাদা ভাবে সিনেমাটির গল্পটি বলেছেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রেক্ষিতে নন-লিনিয়ার স্টাইলে চলচ্চিত্র নির্মাণ খুব একটা দেখা যায় না। লিনিয়ার ফিল্ম বলতে আমরা বুঝি বর্ণনামূলক গল্প। সরলভাবে কাহিনি চলতে থাকবে। ‘দহন’-এও কেন্দ্রীয় চরিত্র তুলার কণ্ঠে সিনেমার ন্যারেশেন শুরু হয়। প্লট সেভাবে এগোলেও এটাকে পুরোপুরি নন-লিনিয়ার বলা যাচ্ছেনা। নন-লিনিয়ারের ফরম্যাট বলতে যেটাকে বোঝায় ‘দহন’র স্ক্রিপ্টে সরাসরি সেটা ফলো করা হয়নি। এই কারণে অনেকের কাছে সিনেমার প্রথমার্ধ বেশ গোলমেলে লাগতে পারে—বিশেষ করে এক টাইম ফ্রেম থেকে অন্য টাইম ফ্রেমে শিফটিংয়ের ক্ষেত্রে। তবে পুরোপুরি সফল না হলেও বেশ ভালোভাবে বিষয়টি হ্যান্ডেল করেছেন পরিচালক। এজন্য তিনি সাধুবাদ প্রাপ্য।

‘তুলা’ ২০১৮ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অন্যতম দাবিদার হবেন

অভিনেতা হিসেবে সিয়াম আহমেদ ‘পোড়ামন ২’থেকে ‘দহন’-এ  ছিলেন অনেক বেশী পরিপক্ক। তাকে দেখেই বোঝা গিয়েছে যে কী পরিমাণ ডেডিকেশন এই ‘তুলা’ চরিত্রের পেছনে দিয়েছেন। এ ধারা বজায় রাখতে পারলে একজন পরিপক্ক অভিনেতা হতে তার খুব একটা সময় লাগবেনা। অযাচিত কোন এক্সপ্রেশন ছিল না। বিশেষ করে জেল খানার ছোট্ট ভেন্টিলেটর দিয়ে মুক্ত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আলোর পথে ফেরার সিম্বলিক দৃশ্যে তার এক্সপ্রেশন ছিল পুরো সিনেমার সেরা দৃশ্যগুলোর একটি। চরিত্রটির জন্য ২০১৮ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অন্যতম দাবিবার হবেন তিনি।

‘আশা’ চরিত্রের পূজা।

শুধু সিয়াম নয়, পূজা চেরির ডেডিকেশনও ছিলো চোখে পড়ার মত। মেয়েটা এই বয়সেই যে পরিমাণ প্যাশনেটভাবে একের পর এক ভালো কাজ উপহার দিয়ে যাচ্ছে তা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। ‘আশা’ চরিত্রে তাকে একদমই ‘পূজা’ মনে হয়নি বরং একজন গার্মেন্টসকর্মীই মনে হয়েছে। আর সাংবাদিক চরিত্রে এত কিছুর পর মমকেই ভালো মনে হয়েছে। খুব সাবলীলভাবে সিনেমায় তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

নেতা ফজলুর রহমান বাবু ছিলেন দুর্দান্ত

ইদানিংকালের চলচ্চিত্রে ফজলুর রহমান বাবু থাকবেন এবং তাকে নিয়ে আলোচনা হবে না,এটা হতে পারে না। তিনি নেতার চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন দুর্দান্তভাবে। ভয়েস চেঞ্জ করে তার ডায়লগ ডেলিভারিগুলো লিডার চরিত্রটিকে একটি অন্যমাত্রা প্রদান করেছে।

‘দহন’-এর সব থেকে বেশী দৃষ্টিনন্দন হচ্ছে গ্রাফিক্স। বিশেষ করে বাসের ভিতর ও পত্রিকার পাতার নিউজ— আসলেই প্রশংসা পাবার মত ছিল।

‘দহন’র প্রধান তিন চরিত্র আশা, তুলা ও সাংবাদিক ‘আপা’

প্রতিটা ছোট ছোট জিনিসের ডিটেইলস ধরে ধরে দেখানো হয়েছে যা অবশ্যই সিনেমার গল্পের প্রয়োজনেই করা হয়েছে। সিনেমেটোগ্রাফির কাজ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে কাঁচের টেবিলে মোবাইল বেজে ওঠা কিংবা সিয়ামের জেলখানার মেঝের পানিতে হেটে যাবার দৃশ্যগুলো। অনেকদিন পর এ ধরণের লোয়ার ক্লোজশটগুলো চোখে শান্তি এনে দিয়েছে। সিনেমায় রিয়েল লোকেশন ব্যবহার ভালো লেগেছে— যা কিনা সিনেমা দেখায় আলাদা একটা আরাম দেয়। এর ফলে দর্শক সহজে নিজেকে রিলেট করতে পারে কিংবা বলতে পারে—আরে এই পথ দিয়ে তো আমি রোজ চলাচল করি।

‘দহন’-এর শেষটা নিয়েও রায়হান রাফি খেলেছেন দর্শকদের সাথে। পরিপূর্ণ কোন উত্তর না দিয়েই তিনি শেষ করেছেন। ‘টু বি অর নট টু বি’র মধ্যে ‘আশা’কে রেখে দিয়েছেন।

যারা নিয়মিত বিদেশী সিনেমা দেখেন তাদের চোখে এতো ভালোর পরও কিছু জিনিস খারাপ লাগবে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে একের পর এক ‘গ্ল্যাডিয়েটর’,’ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ওয়েস্ট’,’স্ল্যামডগ মিলিওনিয়ার’র মিউজিক ব্যবহার না করলে ‘দহন’ আরো দুর্দান্ত কিছু হয়ে উঠতো। ধার করা জিনিস ব্যবহার করাটা আপত্তিজনক। এত বাজেটের সিনেমায় কেন সংগৃহীত মিউজিক ব্যবহার করতে হবে? ব্যাপারটি বড়ই দুঃখজনক।

গানের প্লেসমেন্ট ঠিকঠাক লাগেনি। মনে হয়েছে হুট করে চলে এসেছে।

পরিশেষে বলব, ‘দহন’ দেখে ২০১৩-১৫ সমটায় ‘পেট্রোল বোমা’য় বার বি কিউ হওয়া কারও আপনজন হলে বা না হলেও আপনি মনের অজান্তে  হাও মাও করে কেঁদে দিতে পারেন। পুরো পরিবার নিয়ে ‘দহন’ আজই দেখে ফেলুন।

রেটিং-৭.৫/১০