২০১৭ তে আমার প্রিয় ‘ম্যাজিক্যাল আর্ট’

সিনেমা সিনেমা সিনেমা— এর চেয়ে দারুণ ম্যাজিকাল আর্ট আর কি হতে পারে? মুহুর্তেই আমাদের ভিতরকার ইমোশনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়— যেন নিজের অজান্তেই নিজে হয়ে উঠি সিনেমার চরিত্র। আর সেসব চরিত্রের ভালো লাগা, খারাপ লাগা কাজ করে আমাদের মধ্যে সুচারুরূপে।

প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় দু হাজার পাঁচশ থেকে তিন হাজারের  মত সিনেমা রিলিজ হয়। কিছু সিনেমা জায়গা করে নেয় কালের গর্ভে। ঢুকে যায় আমাদের পছন্দের তালিকায়। আবার বছর ঘুরতেই আরেক নতুন সিনেমা এসে জায়গা করে নেয় পুরনোকে সরিয়ে। এভাবেই পছন্দের জায়গা বদল চলতে থাকে।

একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬০ দিন সিনেমা দেখার একটা প্রয়াস থাকে। এই একটা কাজ সারাবছর ভীষণ আগ্রহ আর মনযোগের সাথে করি। সিনেমা আমি ভীষণ ভালোবাসি। প্রতিবছর রিলিজ হওয়া সিনেমার মধ্যে কিছু সারা বছরব্যাপী মনের মধ্যে বারবার উঠে আসে। কোন বছর সিনেমা মুগ্ধতার বৃষ্টি মুষলধারে ঝরে আবার কোন বছর বৃষ্টি ধীর লয়ে ঝরে।   

২০১৭ তে কিছু সিনেমা ঠিক আমার বুকের মধ্যে এসে আছড়ে পড়েছে। সে সমস্ত সিনেমা নিয়ে এক ধরণের তথ্য বিনিময় বা আমার অনুভুতি প্রকাশ করছি। আর বিনীতভাবে বলে রাখছি, আমি কিন্তু কোনভাবেই জাজ করছি না। নিজের ভালো লাগা সিনেমাগুলো তুলে ধরছি যা ২০১৭ তে সারা বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেয়েছে এবং আমার ভিতর জায়গা করে নিয়েছে। আলোচনার সুবিধার্ধে সিনেমার ইন্ডাস্ট্রি অনুযায়ী ভাগ করে নিচ্ছি পছন্দের সিনেমাগুলো।

 

‘ঢাকা অ্যাটাক’র একটি দৃশ্যে আরিফিন শুভ ও মাহিয়া মাহি

ঢালিউড

আলোচনার শুরুটা অবশ্যই ‘ঢাকা অ্যাট্যাক’ দিয়ে। টানা ৯০ দিন সিনেমাটি মাতিয়ে রেখেছিল দেশবাসীকে। এরপরও চলছে অনেকদিন। দীপঙ্কর দীপনের পরিচালিত এই সিনেমার সংলাপ লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সিনেমাটি দর্শকদের অভাবনীয় আগ্রহের অন্যতম কারণ এর নির্মাণ কৌশল। গতানুগতিক গল্পের বাইরের গল্প। চমৎকার অভিনয়, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আর অবশ্যই এই সিনেমার সম্পাদনা।

এছাড়া ২০১৭ তে মুক্তিপ্রাপ্ত অন্যান্য সিনেমা যা দর্শকের আগ্রহ তৈরি করে— যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘নবাব’ ও ‘বস টু’। এছাড়া দেশীয় প্রযোজনার সিনেমা ‘রাজনীতি’। সরকারী অনুদানে নির্মিত সিনেমা ‘ভুবন মাঝি’ ও ‘নুরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার’।

 

টালিউড ও বলিউড

এবার জানাতে চাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর বিশ্বের ২য় বৃহত্তম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ভারতের সিনেমাগুলো নিয়ে। 

শুরু করতে চাই পশ্চিম বাংলার অতনু ঘোষ পরিচালিত ‘ময়ূরাক্ষী’ দিয়ে। সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জির বাবা ছেলের সম্পর্কের গল্প এটি। এ সম্পর্ককে ঘিরে তাদের চারপাশের জীবন প্রবাহ এক অন্য দ্যোতনা তৈরি করে। ‘ময়ূরাক্ষী’ যেন কবিতার মত।

ময়ূরাক্ষী— বাবা ও সন্তানের ভালোবাসার কাহিনি

এরপর মুম্বাইয়ে আমার অন্যতম প্রিয় পরিচালক বিক্রমাদিত্য মাটোয়ানির ‘ট্র্যাপড’-এর কথা বলব। অসাধারণ গল্প আর সেই সাথে রাজকুমার রাও এর মন্ত্রমুগ্ধকর অভিনয়। পছন্দের তালিকায় আরও রয়েছে— নিউটন, কাদোই হাওয়া, পর্না, মুক্তি ভবন, রিবন আর ইরফান খানের অনবদ্য অভিনয়ের ভিন্ন ধারার হিন্দি সিনেমা ‘হিন্দি মিডিয়াম’।

 

হলিউড  

গতবছর দারুণ সব সিনেমা রিলিজ পেয়েছে হলিউডে। আমার পছন্দের সিনেমার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ‘ব্ল্যাক সোয়ান’খ্যাত  ড্যারেন আরনোস্কি পরিচালিত ‘মাদার’। এটিকে আমার ম্যাজিকাল পোয়েট্রি বলে মনে হয়। হাভিয়ার বারদেম  আর জেনিফার লরেন্সকে রক্তের মত বয়ে চলতে দেখেছি এই সিনেমায়।

অফকোর্স আমার পছন্দের তালিকার দ্বিতীয় সিনেমা হচ্ছে গ্রেটি গ্রুইগ পরিচালিত ‘লেডি বার্ড’। এরপর যথারীতি ফ্যান্টম থ্রেড, কল মি বাই ইউর নেম, গেট আউট, ডানকার্ক, ফ্লোরিয়া প্রজেক্ট, দ্য পোষ্ট এবং গুড টাইম।  

‘মাদার’ সিনেমার পোস্টার

 

এশিয়া

২০১৭ সালে  আমার পছন্দের শুরুতে রয়েছে ইরানি সিনেমা ‘দ্য পট এন্ড দ্য ডাক’। এরপর কোরিয়ান সিনেমা ‘আ ট্যাক্সি ড্রাইভার’ এবং  ‘ব্যাটলশিপ আইল্যান্ড’। জাপানি সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘মেমোরিস অফ আ মার্ডারার’, ‘আই চুজ ইউ’ এবং ‘ক্রিমসন লাভ লেটার’ ভালো লেগেছে।

 

আফ্রিকা

আমরা অনেকেই আফ্রিকা বলতে কেবল দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুরুত্ব দেই। তাদেরকে জানিয়ে রাখি সিনেমায় আফ্রিকায় সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে নাইজেরিয়ার নলিউড। শুধু আফ্রিকা না সমস্ত বিশ্বেই নাইজেরিয়ার সিনেমা দারুণভাবে সমাদৃত হচ্ছে।

গতবছরও দারুণ কিছু সিনেমা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে নাইজেরিয়া। আর আমার পছন্দের প্রথমেই আছে ‘দ্য উন্ড’ ও ‘দ্য ড্যামেন্ড’। এরপর-ই রয়েছে ঘানার সিনেমা ‘অ্যাডাম এন্ড দ্য ইভ’ এবং সাউথ আফ্রিকার ‘জাগভেড’।

 

ইউরোপ

ইউরোপিয়ান সিনেমাগুলোর মধ্যে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে  লিসা অ্যাজউয়ুলেস পরিচালিত ‘ডালিডা। এরপর লে সিক্রেট দ্য লা সাম্বার ‘নোর’, মন্সিউর ‘অ্যান্ড ম্যাডাম অ্যাডেলম্যান’, ‘রক অ্যান্ড রোল’এবং ‘ডিমেইন টট কমেন্স’।

লেডি ম্যাকবেথ

 

বৃটেন

 

বৃটিশ ফিল্মের মাঝে প্রথমেই রয়েছে উইলিয়াম অল্ড্রেড পরিচালিত ‘লেডি ম্যাকবেথ’। এরপর লুকা গুয়াদাগোনিনো পরিচালিত ‘কল মি বাই ইউর নেম’। তারপর-ই রয়েছে সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘ব্রেথ’। ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’, ‘ব্যাটল অফ দ্য সেক্সেস’ এবং ‘ওয়ান্ডার’— এগুলোও পছন্দের তালিকায় রয়েছে।   

সুইডিশ সিনেমায় রয়েছে  রুবেন অস্টল্যান্ড পরিচালিত ‘দ্য স্কয়ার’। জার্মান ফিল্মেগুলোর মধ্যে পছন্দের তালিকায় এক নাম্বারে জায়গা করে নিয়েছে ভিনসেন পেরেজ পরিচালিত ‘আলোন ইন বার্লিন’— একে আপনি চোখ বন্ধ করে ক্লাসিক ওয়ার্ক বলতে পারেন। আর এরপরেই রয়েছে হিটলারকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে দারুণ ড্রামামুভি ‘থার্টিন মিনিটস’।

সাম্প্রতিক সময়ে নাইজেরিয়ার পাশাপাশি পোল্যান্ডের সিনেমাও আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের থেকে আলাদা একটা চার্ম পাওয়া যায় পোলিশ সিনেমায়। আর ২০১৭ তে মুগ্ধ হওয়া পোলিশ সিনেমার শুরুতেই রয়েছে অ্যাগনিয়েস্কা হল্যান্ড পরিচালিত ‘স্পর’। এরপর রয়েছে ক্যাটারজিনা অ্যাডামিক পরিচালিত ‘অ্যামক’। আরো রয়েছে ‘ভল্টা’, ‘স্লিপ মাই লাভ’ এবং ‘ওয়াইল্ড রোজেস’।

 

ল্যাটিন আমেরিকা

 

বিশ্ব সিনেমায় ল্যাটিন আমেরিকান সিনেমা এক দারুণ বিস্ময় আর মুগ্ধতা ছড়ায়। অদ্ভুত চমৎকার সব সিনেমা হয় ল্যাটিনে। যেমন ২০১৭ তে ব্রাজিলের কিছু সিনেমা আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘টু আইরিনস’, ‘বিঙ্গো’, ‘ইয়নলু’ এবং ‘গুড ম্যানারস’।

কলম্বিয়ান সিনেমার মধ্যে ভিক্টর গ্যাভিরিয়া পরিচালিত ‘লা মুজের ডেল অ্যানিমেল’ সবচেয়ে পছন্দের। এরপরেই রয়েছে ‘এক্স কুইনোটিয়োস’।

অন্যান্য ল্যাটিন সিনেমার মাঝে রয়েছে চিলির স্যাবাস্টিয়ান লিও পরিচালিত ‘উনে মুজের ফ্যান্টাস্টিকা। আর্জেন্টিনার আনে বারনেরির ‘অ্যালানিস’। নিকারাগুয়ার প্যাট্রিসিয়া রামোস পরিচালিত ‘অ্যাল টেকো’।

ম্যাক্সিকান সিনেমার মধ্যে ভালো লেগেছে রবার্তো স্নিডের পরিচালিত ‘মি অ্যাসতোস ম্যাটান্ডো সুসানা’ ও তাতিয়ানা হুজো পরিচালিত ‘টেম্পেস্টেড’।

 

আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে ২০১৭ তে এই সিনেমাগুলো না দেখলেই নয়। এর বাইরে বহু সিনেমা দেখা হয়নি। নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় অনেক দারুণ দারুণ সিনেমা মিস করেছি আর প্রতিবছর এই মিস করার সংখ্যা বেড়েই চলবে। কেননা প্রতিবছর হাজার তিনেক সিনেমা রিলিজ হলে  মিস হওয়াটা স্বাভাবিক।

সিনেমা দেখা নিয়ে আমার মুগ্ধতা আসমান ফুড়ে মহাশূন্যে যাত্রা করলেও আমার ক্লান্তি আসবে না। বরং মুগ্ধতা এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে। কেননা সিনেমা হচ্ছে ম্যাজিক্যাল আর্ট।