bishal bhardwaj

বহুমুখী কর্মে স্বতন্ত্র বিশাল ভারদ্বাজ

‘আমি মনে করি তিনি দুর্দান্ত সিনেমা বানান, যদিও তার সবগুলো কাজ আমার ভাল লাগেনি। কিন্তু তার সবচেয়ে খারাপ কাজটিও অনেকের তথাকথিত ভাল কাজের চেয়ে বেশি দুর্দান্ত হয়।’

গুণী অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ একজন নির্মাতা হিসেবে বিশাল ভারদ্বাজকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই কথাগুলো বলেন।vishal bharadwaj

বলিউড সম্পর্কে যাদের মোটামুটি ধারণা আছে তারা এক নামেই বিশাল ভারদ্বাজকে চিনেন। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে যেখানে একটি পরিচয় দাঁড় করাতে দিনের পর দিন সাধনা করতে হয়, সেখানে এই বহুমুখী প্রতিভাবান ব্যক্তি সমান্তরালভাবে দুই দুটি পরিচয় বহন করছেন— সুরকার ও চিত্রনির্মাতা।

এই দুই পরিচয়েই তিনি পেয়েছেন প্রশংসা, পুরস্কার এবং একই সঙ্গে জনপ্রিয়তা। এর বাইরে প্লেব্যাক শিল্পী, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার এবং প্রযোজক হিসেবেও তার পরিচয় আছে। ‘বিড়ি জ্বালাইলে’ ও ‘ধ্যান ট্যা ন্যান’-এর মত চার্টবাস্টার গান কিংবা ‘মকড়ী’, ‘মকবুল’, ‘ওমকারা’, ‘কামিনে’, ‘হায়দার’-এর মত জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত সিনেমা যার হাতে তৈরী হয়েছে তাকে আর আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার পড়ে না।bishal bhardwaj

সঙ্গীত দিয়ে  প্রথম পরিচিতি

বিশাল ভারদ্বাজ বলিউডে কাজ শুরু করেন একজন সুরকার হিসেবে। অথচ ছোটবেলা তার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবেন। এর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন।  কিন্তু ১৯ বছর বয়সের তরুণের সামনে বাবার আকস্মিক মৃত্যু জীবনের সব হিসেব নিকেশ পাল্টে দিতে যথেষ্ট।

ভারদ্বাজ এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘বাবার মৃত্যু আমার মৃত্যুভীতি কাটিয়ে দিয়েছে। কারণ এটি মানবজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের মৌলিক ভীতিগুলোর একটি। একবার এই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারলে জীবনের যে কোন বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়।’

তিনি নিজে না শিখলেও তার বাবা রাম ভারদ্বাজ গানের সাথে জড়িত ছিলেন। পুলিশের চাকুরীর পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য তিনি গান-কবিতা লিখতেন। বেশ কিছু সিনেমার জন্য গান লিখেন। ১৭ বছর বয়সে বিশাল বাবার লেখা গানে সুর করেন। বাবার মৃত্যুর পর বাবার নির্মাতা বন্ধু বিশালের তৈরী সেই গান সিনেমায় ব্যবহার করেন।

১৯৯৫ সালে ‘অভয়–দ্য ফিয়ারলেস’-এর গান দিয়ে বলিউডে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু। ১৯৯৬ সালে ‘মাশিস’ সিনেমার গানগুলোর জন্য প্রশংসা পান। এরপর ‘সত্তা (১৯৯৮)’ এবং ‘গডমাদার (১৯৯৯)’ তাকে ভিন্ন ধারার সুরকার হিসেবে বলিউডে ব্যাপক পরিচিতি দেয়। শেষটার জন্য তিনি ‘সেরা সঙ্গীত পরিচালক’ হিসেবে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তোলেন।

তবে মূলধারার দর্শকদের কাছে বিশাল ভারদ্বাজ জনপ্রিয়তা পান তার নির্মিত ‘ওমকারা (২০০৬)’-এর ‘বিড়ি জ্বালাইলে’ এবং ‘কামিনে (২০০৯)’-এর ‘ধ্যান ট্যা ন্যান’ গান দিয়ে। এছাড়া ‘ইশকিয়া (২০১০)’-এর ‘দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি’ এবং ‘সাত খুন মাফ (২০১১)’-এর ‘ডার্লিং’ও জনপ্রিয় হয়। যদিও আমার মতে, বিশাল ভারদ্বাজ ভিন্নধারার ‘সউলফুল গান’-এর জন্য সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে বলিউডের অন্যতম সেরা সুরকার হয়ে থাকবেন। ‘ওমকারা’র ‘ও সাথী রে’, ‘কামিনে’র ‘পেহলিবার মহাব্বাত’, ‘সাত খুন মাফ’-এর ‘আওয়ারা’ এবং ‘এক থি ডায়ান (২০১৩)’-এর ‘ইয়ারাম’ ‘সউলফুল গান’-এর অন্যতম উদাহরণ।

‘ওমকারা’র ‘ও সাথী রে’ এবং ‘কামিনে’র টাইটেল গানটিসহ নিজের সুরে কিছু গান তিনি গেয়েছেন। তবে গায়কীতে স্ত্রী রেখা ভারদ্বাজকে গুরু মানেন। কলেজ জীবনে রেখার প্রেমে পড়ার মধ্য দিয়ে তার সঙ্গীত প্রেমের শুরু। রেখাকে ইমপ্রেস করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল।

বিভিন্ন শাখায় পাওয়া সাতটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মধ্যে তিনটি-ই সুরকার হিসেবে— ‘গডমাদার’, ‘ইশকিয়া(২০১০)’ এবং ‘হায়দার (২০১৪)’।Vishal Bhardwaj

নির্মাতা হিসেবে আরো বেশি স্বতন্ত্র

মিউজিশিয়ান হিসেবে ‘মাশিস’-এর জন্য ফিল্মফেয়ার থেকে ‘আরডি বর্মন বেস্ট নিউ ট্যালেন্ট ইন মিউজিক’ জিতলেও বলিউডের গতানুগতিক রোমান্টিক সংগীতের যুগে ভিন্নধারা কাজের খুব একটা সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার জন্যই নিজেই সিনেমা নির্মাণে আসেন।

প্রথম সিনেমা ‘মকড়ি(২০০২)’ মূলত নির্মাণ করেন ‘চিল্ড্রেনস ফিল্মস সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’র জন্য। কিন্তু সিনেমাটি দেখে তারা প্রত্যাখান করেন— বাজে চিত্রনাট্য ও দুর্বল সিনেমাটোগ্রাফি আখ্যা দিয়ে। এই ঘটনা বিশালের জেদ বাড়িয়ে দেয়। তখনো ইন্ডাস্ট্রিতে শক্ত অবস্থান গড়তে না পারলেও ২০-৩০ লাখ টাকা দিয়ে নিজেই তাদের কাছ থেকে সিনেমাটি কিনে নেন। এরপর এটি বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণ করে মুক্তি দেন— সমালোচকদের প্রশংসার পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবেও সফল হয়। যদিও তার মতে, তার সিনেমার সাফল্যকে ইন্ডাস্ট্রি কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। ইন্ডাস্ট্রিতে সবসময়ই বলা হয় ভারদ্বাজের সিনেমা প্রশংসিত হলেও টাকা তুলতে পারে না।

তবে বিশাল ভারদ্বাজ তার সিনেমা দিয়ে আর্ট এবং বাণিজ্যের মধ্যকার দূরত্ব যে অনেকখানি ঘুচিয়েছেন তা বোঝা যায় ‘মকবুল’, ‘কামিনে’সহ অন্য সিনেমাগুলোর ডিসেন্ট বক্স অফিস সাফল্য দিয়ে।

বিশাল প্রথম সিনেমায় শাবানা আজমীর মত তারকা অভিনেত্রীর সাথে কাজ করেছেন। এরপর টাবু, সাইফ আলী খান, অজয় দেবগন, কারিনা কাপুর, কঙ্কনা সেন শর্মা, বিবেক ওবেরয়, বিপাশা বসু, শাহীদ কাপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, জন আব্রাহাম, ইরফান খানদের মত তারকারা তার সিনেমায় অভিনয় করেছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে তারকা নায়কদের চেয়ে তারকা নায়িকাদের সাথে কাজ করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বিশাল। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “নায়করা নায়িকাদের চেয়ে অনেক বেশী ইমেজ সচেতন। তাদের নিয়ে কাজ করতে গেলে নানা প্রশ্ন, নানা শর্ত মোকাবেলা করতে হয়। ‘ওমকারা’র নায়করা খালি গায়ে শুট করতে ইতস্তত করছিল। দর্শকরা তাদের ‘বডি’ পছন্দ করবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। শট দেয়ার আগে জিম করে ‘বডি’ আকর্ষণীয় করার জন্য সময় দরকার তাদের। অথচ ছবিতে তারা নিতান্তই গেঁয়ো শ্রমিক— যেখানে সাধারণ লুকটাই দরকার। নায়িকাদের নিয়ে এসব ঝামেলা পোহাতে হয়নি আমাকে। তারা নায়কদের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী ও নিবেদিত।”

বিশাল ভারদ্বাজের সিনেমায় সাহিত্যের প্রভাব থাকে। তার সবচেয়ে প্রশংসিত সেক্সপিয়ারিয়ান ট্রিলজি— মকবুল (ম্যাকবেথ), ওমকারা (ওথেলো) এবং হায়দার (হ্যামলেট) তাকে ভারতীয় সিনেমায় শক্ত অবস্থান দিয়েছে। এছাড়া ‘দ্য ব্লু আমব্রেলা (২০০৫)’ এবং ‘সাত খুন মাফ’ বন্ধু সাহিত্যিক রুসকিন বন্ডের উপন্যাস থেকে তৈরী।

‘সেক্সপিয়ারিয়ান ট্রিলজি’ উইলিয়াম সেক্সপিয়ারের ৪০০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে লন্ডনে প্রদর্শন করা হয়। যার সহযোগী আয়োজক ছিলো ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট।

প্রযোজক হিসেবেও বিশাল ভারদ্বাজ ভিন্ন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। নিজের পরিচালনার বাইরে প্রযোজনা করেছেন অনুরাগ কাশ্যপের ‘নো স্মোকিং (২০০৭)’, তার সহকারী পরিচালক অভিষেক চৌবের ‘ইশকিয়া (২০১০)’, মেঘনা গুলজারের ‘তলওয়ার (২০১৫)’-এর মতো প্রশংসিত  সিনেমা।

তার প্রযোজিত-পরিচালিত ‘দ্যা ব্লু অ্যামব্রেলা’ ‘সেরা শিশুতোষ  চলচ্চিত্র’ হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। ‘ওমকারা’ পেয়েছে ‘বিশেষ জুরি পুরস্কার’। চিত্রনাট্যকার হিসেবে ‘হায়দার’ ও ‘তলওয়ার’-এর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

বলিউডের সবচেয়ে সংস্কারপন্থী নির্মাতা

নির্দিষ্ট ছাঁচে নিজেকে সঁপে না দিয়েও বাণিজ্যিক সিনেমা বানিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। দেখিয়েছেন কীভাবে ভিন্নধারার সিনেমাকেও সাধারণ দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করা যায়। ‘হয় ভাল না হয় মন্দ’ এমন গতানুগতিক ছকে না গিয়ে পর্দায় একধরণের ‘গ্রে’ চরিত্র নিয়ে এসেছেন—ভাল-মন্দের মিশেলে কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে উঠে তারা। সাইফ আলী খান, শাহীদ কাপুর কিংবা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ারার মত বাণিজ্যিক তারকারা গ্ল্যামারাস ইমেজ ভেঙ্গে দর্শকদের মনে আরো শক্তভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। এভাবেই বিশাল ভারদ্বাজের মত নির্মাতারা একটু একটু করে গতানুগতিক চলচ্চিত্রধারার সংস্কার করেন। তাই তাকে আমি বলি বলিউডের অন্যতম সংস্কারপন্থী নির্মাতা। যার কর্ম হিট-ফ্লপের বিচারে পরিমাপ করা যায় না।

তথ্যসূত্র

১। উইকিপেডিয়া ( https://goo.gl/EQSMzd )

২। দ্যা টাইমস্‌ অব ইন্ডিয়া ( https://goo.gl/2xmRkb )

৩। মিন্ট ( https://goo.gl/K5uAeH )

৪। হিন্দুস্তান টাইমস ( https://goo.gl/92JBDM )

৫। ওপেন ম্যাগাজিন ( https://goo.gl/FWusQ )

০৮.০৬.২০১৭

বিঃদ্রঃ লেখাটি ‘তারকা সংবাদ প্রেজেন্ট জাস্ট বলিউড রাইটিং কনটেস্ট ২০১৮’-এ প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.