rajkumar hirani

প্রথাভাঙ্গা হিরানীর শুরুর গল্প

২০০৫ এর জুলাই মাস। মুম্বাইতে বয়ে যাচ্ছে মহাপ্লাবন। কয়েক দিন থেকেই ঘরবন্দী একজন পরিচালক। চোখ গেল বাসার বুক সেলফ এর উপর। হাতে তুলে নিলেন ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান’ নামের বইটা। কিছুদিন আগেই তার আপকামিং সিনেমার নায়িকা বিদ্যা বালান তাকে বইটা পড়তে দিয়েছিলো। বইটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিন বন্ধুর গল্প। পড়তে পড়তে তার মনে পড়ে গেল একইরকম একটা গল্প লিখে রেখেছিলেন। সাথে সাথে তিনি বইটার সত্ব কিনে নেন। এরপর বইয়ের গল্প আর নিজের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে বানিয়ে ফেলেন বলিউডের সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’।

বলিউড ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম পরিচালক রাজকুমার হিরানী— যাকে বলা হয় প্রথাভঙ্গকারী পথপ্রদর্শক। আজ আমরা শুনবো তার শুরুর গল্প।

ভারতের নাগপুরে তার জন্ম। বাবা সুরেশ হিরানী, যার জীবন ছিলো বেশ সংগ্রামী। জীবনের সব জমানো টাকা দিয়ে তিনি দিয়েছিলেন একটা টাইপরাইটিং ইন্সটিটিউট। নাম দিয়েছিলেন ‘রাজকুমার কমার্স ইন্সটিটিউট’। এর নাম থেকে নিজের ছেলের নাম রাখেন রাজকুমার। যেখানে সবাই নিজের সন্তান এর নামের সাথে মিলিয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর নাম রাখেন, সেখানে রাজকুমার হিরানীর ক্ষেত্রে ব্যপারটা হয়ে গেল উল্টা।

পরিবারের ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ানোর। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে কম মার্ক থাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়নি। ভর্তি হয়ে গেলেন চাটার্ড একাউন্টেট কোর্সে। তবে কিছুদিন ক্লাস করেই তার বিরক্তি এসে গেল এবং উপলব্ধি করলেন এই জায়গা তার জন্য না। তবে ছাড়তেও ভয় পাচ্ছিলেন। একে তো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে পারেননি তার উপর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের চিন্তা। সব মিলিয়ে বেশ দোটানা এবং অস্বস্তিতে ভুগছিলেন তিনি।

rajkumar hirani
একটা সময় ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিলেন হিরানী। ছবিঃ গুগল

এভাবেই চলতে চলতে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলো। পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে প্রায়ই ভয়ানক স্বপ্নে পুরো শরীরে ঘাম দিয়ে ঘুম টুঁটে যেত।

এভাবে আর না। এক রাতে সিদ্ধান্ত নিলেন চ্যাটার্ড একাউন্টেট পড়া বাদ দেবার।

এরপরের সন্ধ্যাটা নাগপুরের অন্যসব সন্ধ্যার মতই ছিল। তবে ওই সন্ধ্যাটাই হতে যাচ্ছিল রাজকুমার হিরানীর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় সন্ধ্যা। বাবাকে কীভাবে বলবেন পড়াশোনা ছেড়ে দেবার কথা— ভাবতেই বারবার গলাটা ধরে আসছিলো। কোনভাবে বলতে পারার পর বাবা তাকালেন তার দিকে এবং শান্ত গলায় বললেন ‘ঠিক আছে বাদ দাও, কাল থেকে আমার অফিসে বসো’।

বাবার সাথে হিরানী। যার সাপোর্ট না পেলে আজকের হিরানীর জন্ম হত না। ছবিঃ গুগল

কাঁধ থেকে পৃথিবী সমান ভার নেমে যাওয়ার অনুভূতি হল তার। সময়টা ছিল মকর সংক্রান্তির। ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুড়ি উড়ালেন। সেই থেকে ঘুড়ি উড়ানোটা তার কাছে স্বাধীনতার প্রতীক মনে হয়। আর ওই সন্ধ্যার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই লিখেছিলেন ‘থ্রি ইডিয়টস’- এর ফারহান এবং তার বাবার কথোপকথনের দৃশ্যটুকু।

ইলেক্ট্রনিক ক্যালকুলেটর রিপেয়ারিং এর জন্য দিল্লি তে একটা কোর্স ও করেছিলেন হিরানী। ওই সময়টাতে তিনি থিয়েটারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। পরিচিতদের নিয়ে নরেন্দ্র ঠাকুর নামের একজনের সাথে গড়া থিয়েটার গ্যাংয়ে যুক্ত হন। এখানে কিছুদিন কাটানোর পর নাগপুর মেডিকেল কলেজ স্টুডেন্টদেরকে নিয়ে ‘আওয়াজ’ নামের থিয়েটার গ্রুপ গড়েন। বছরে তিন থেকে চারটি শো নামাতেন এই গ্রুপ থেকে। অভিনয় ছাড়াও হল বুকিং, সেট বানানো, টিকেটিং, কস্টিউম সব নিজেরাই করতেন। আয়ের উদ্দেশ্য ছিলনা না তাদের। কোনভাবে নাটকটা মঞ্চস্থ করতে পারলেই তারা খুশি।

থিয়েটারের প্যাশন দেখে তার বাবা তাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা নিতে বলেন। এজন্য তখন একটাই ভালো চয়েজ ছিল, তা হল FTII ( Film & Television Institute of India)। তবে সেখানে প্রথমবার পরীক্ষা দিয়ে টিকলেন না। বুঝলেন এখানেও ব্যাংক এক্সামের মত পড়াশোনা করেই পরীক্ষা দিতে হয় এবং প্রায় সবাই ডিরেকশন কোর্সে ভর্তি হতে চায়। পরেরবার আবার পরীক্ষা দিলেন। তবে সেবার আর ডিরেকশন কোর্সে না, এডিটিং কোর্সে।

রাজকুমার হিরানী এফটিটিআই-এ ছাত্রাবস্থায়। ছবিঃ গুগল

এবার পেয়ে গেলেন অ্যাডমিশন। সময়টা ছিল তার জীবনের অন্যতম সুখের মুহূর্ত। সেখানে প্রথম দিকে বেশ হীনমন্যতায় ভুগতেন— ছোট শহরের ছোট মানুষ, এত বড় জায়গায় টিকবেন কি? এইসব নিয়ে ভয় কাজ করতো। যদিও অল্পকিছুদিনের মধ্যেই সব ওভারকাম করেন।

তিন বছরের এডিটিংয়ের কোর্স করে তিনি মুম্বাই আসেন। সেখানে থাকতেন ব্যাচমেট শ্রীরাম রাঘবনের (ডিরেক্টরঃ বদলাপুর, এক হাসিনা থি, জনি গাদ্দার) সাথে। আস্তে আস্তে সেখানে বিভিন্ন ছোট বড় প্রজেক্টে এডিটর হিসেবে কাজ করেন।

তখন মাত্র ভিডিও এডিটিংয়ের নতুন টেকনোলজি শুরু হয়েছিলো যার সাথে পরিচিত ছিলেন না হিরানী। তাই মুম্বাইতে প্রথম বছরটা খুব কষ্ট হয়েছিলো তার, খুব একটা কাজ পাচ্ছিলেন না। কেটেছে অনেক নিদ্রাহীন রাত। চেয়েছিলেন আবার নাগপুর ফিরে যাবেন।

ঠিক তখন-ই খবর পেলেন FTII তে একমাসের নতুন ভিডিও কোর্সের ব্যাপারে। সেই কোর্স করে এসে আবার টিকে গেলেন মুম্বাইতে।

১৯৮৮ তে ‘একতা স্টুডিও’ তে এক হাজার রুপি বেতনে এডিটর হিসেবে যোগ দেন।নিজেকে মনে মনে তৈরি করেন এই বলে ‘যদি আমি খুব বেশি টাকা ইনকাম নাও করতে পারি, তবুও আমি সিনেমার প্রতি জীবন উৎসর্গ করে দিবো।’

তখন বিধু বিনোদ চোপড়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন সঞ্জয় লীলা বানিসালি। তিনি হিরানিকে কল করেন ‘১৯৪২ঃ এ লাভ স্টোরি’ সিনেমার প্রমো এডিটিং এর জন্য।এরপরে হিরানী নিজেও কিছু ছোট খাটো অ্যাড ডিরেকশন দেন এবং ১৯৯১ তে নিজের প্রোডাকশন হাউজ ‘ক্যানভাস ফিল্মস’ খুলেন।

‘১৯৯৪২- এ লাভ স্টোরি’ সিনেমার জন্য করা প্রমোটা বেশ পছন্দ করেছিলেন বিধু বিনোদ চোপড়া। যার কারণে তিনি ‘কারীব’ সিনেমার প্রমো এডিটিং এর দায়িত্ব ও হিরানীকে দেন। সবচেয়ে বড় সুযোগটা আসলো ২০০০ সালে যখন বিধু বিনোদ চোপড়া তাকে পুরো ‘মিশন কাশ্মীর’ সিনেমার এডিটিং এর দায়িত্ব দেন। বিধু বিনোদ চোপড়া এবং তার টিমের সাথে কাজ করতে করতেই হিরানী সিনেমা পরিচালনার ইচ্ছাটা জানান।

এই ইচ্ছা থেকেই এক সময় সৃষ্টি হয় ‘মুন্না ভাই এম.বি.বি.এস’। কিভাবে মুন্না ভাই সৃষ্টি হল সেটা একটা বিরাট গল্প। তা না হয় আরেকদিন বলা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.