বাংলাদেশের প্রথম ছবি থেকে শুরু করে সবই তো নকল: আবদুল্লাহ জহির বাবু

আবদুল্লাহ জহির বাবু। নকল চিত্রনাট্য ইস্যুতে যাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বরাবরই আকাশ ছুঁই। আবার এটাও অপ্রিয় সত্যি- দেশীয় চলচ্চিত্র চিত্রনাট্যের ‘নিক নেম’ পদবি তারই দখলে। এ নিয়ে তার মধ্যে খানিক গরিমা থাকলেও কোনও হা-পিত্যেশ নেই। বরং নকলের প্রশ্ন তুলতেই দ্যার্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম ছবি থেকে শুরু করে সবই তো নকল’! আগবাড়িয়ে আরও বলছেন, ‘নকল তো ভাই ক্রাইম না। দরজা খুলে রেখেছেন। আপনার বাসায় ঢুকে আমি কিছু নিয়ে গেলাম- আপনি কিছু না বলা পর্যন্ত আমি তো চোর না। পৃথিবীর কোনও আদালত আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না।’ অভিযুক্ত চিত্রনাট্যে অসংখ্য সফল ছবির এই জনকের জীবনে দুঃখবোধও কম নয়। কথায় কথায় বলেছেন, “আমার বাবা জহিরুল হক(চিত্র পরিচালক) এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক দিয়েছেন। কিন্তু আমি আর আমার বোন মিলে ‘রেটিনা মেডিকেল ভর্তি গাইড’ লিখে বাবার চিকিৎসা খরচ জোগাড় করতে হয়েছিল।” আপাদমস্তক চলচ্চিত্র ভাবনা নিয়ে উত্তর বাড্ডায় একটি ফ্ল্যাটে থাকেন স্ত্রী ফারজানা জহির এবং কন্যা জারা ও পুত্র আনানকে নিয়ে। সেখানে লেখালেখির ছোট্ট একটা রুমে বসে বিস্তর কথা হয়েছে তার সঙ্গে। নানা অভিযোগের বিপরীতে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন মনখোলা কথা। সাজ্জাদ হোসেনের তোলা ছবিসহ সেসব তুলে ধরেছিলাম একটি সাক্ষাতকারে যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে বাংলা ট্রিবিউন-এ। বাংলা ট্রিবিউনে এখন সাক্ষাতকারটি নেই, তাই বাংলা মুভি ডেটাবেজ (বিএমডিবি)-তে সংরক্ষনের উদ্দেশ্যে পুনরায় প্রকাশ করলাম।

এ রুমেই বসেই কি লেখালেখি করেন?
আবদুল্লাহ জহির বাবু: হ্যাঁ, এটাই আমার ‘ওয়ার্কিং স্টেশন’। যত পরিচালক প্রযোজক আসেন সবাই ড্রয়িং রুমে না বসে এখানেই বসেন।

আপনার শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
১৯৯৩তে আমি সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি, ক্লাশ শুরু হয়নি। আব্বার শরীর খারাপ থাকলে কিংবা চিন্তায় থাকলে ভাত খাওয়ার সময় ডাল নিতো খালি। এক রাতে তাকে এরকম করতে দেখে জিজ্ঞেস করতেই কারণ বললেন- সকালে প্রযোজককে গল্প শুনাতে হবে। কিন্তু মাথায় গল্প আসছে না। তখন আমি একটা গল্প শোনালাম- একটা গরীব ছেলের বড়লোক সাজার গল্প। আব্বা গল্পটা শুনে সাহস দিলেন। সাহস পেয়ে আমি সারা রাত জেগে একটি গল্প দাঁড় করালাম। সকালে দেখানোর পর আব্বা বললেন, এটার ফিনিশিং লাগবে তো। আমি করলাম কী গোবিন্দের ‘শোলা অর শবনম’ ছবির শেষটা মডিফাই করে ইউনিক একটা ‘লাইনআপ’ দাঁড় করিয়ে ফেললাম। কিন্তু চূড়ান্ত স্ক্রিপ্ট তৈরির সময় আমি আর ছিলাম না।

তারপর? সে ছবির শ্যুটিং হয়েছিল?
না, আব্বা মারা গেলেন ছবির অর্ধেক শ্যুটিং বাকি রেখে। নাম ‘তুমি আমার’। আব্বার একটা অভ্যাস ছিল স্ক্রিপ্ট সম্পূর্ণ না করে শ্যুটিং করা। তিনি শ্যুটিং চলাকালীন সবকিছু ঠিক করতেন আর লিখতেন। তার ২০-২৫টা পরিপূর্ণ স্ক্রিপ্ট আছে যেগুলো তিনি শ্যুটিং করে যেতে পারেননি। ফলে উনি মারা যাওয়ার পর ঐ ছবির ইউনিট বিপদে পড়ল। তখন তমিজ উদ্দিন রিজভী আংকেল ছবিটা শেষ করার দায়িত্ব পেলেন। আজাদী হাসনাত ফিরোজ, দেলোয়ার হোসেন বাবুল আব্বার সহকারী ছিলেন। তারা মিলে রিজভী আংকেলকে বুঝালেন, যেহেতু আমি ছবির গল্পটা লিখেছি আমাকে দিয়েই স্ক্রিপ্টটা সম্পূর্ণ করানোর জন্য। যেই ভাবা, সেই কাজ- আমি আর আমার বোন মেহজাবিন মিলে মাত্র দুদিনে স্ক্রিপ্ট শেষ করে ফেললাম। আমার সৌভাগ্য যে কাহিনিকার হিসেবে আমার নাম দিলেন তারা পর্দায়। সেই থেকে শুরু।

বাবার অবর্তমানে অসম্পূর্ণ কাজটি খুব সহজেই নামিয়েছেন মনে হচ্ছে…
সেটাও আব্বার কারণেই। তার কারণে ছোট বেলা থেকে আমরা ভাই-বোন ‘মুভি ফ্রিক’ ছিলাম। দেশে নতুন ভিসিআর আসছে মাত্র। আমি আমার বোন মিলে ভিসিআর-এ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ২৯০০টি ছবি দেখেছিলাম! তাছাড়া আব্বা যখন একটা ছবি আমাদের নিয়ে দেখতেন তখন বিশ্লেষণ করতেন- এ ছবির গল্প ঠিক নাই, গল্পের গভীরতা নাই- এরকম আরকি। ফলে আমাদের জন্য এটা তেমন কোনও ব্যাপার ছিল না।

এরপরের গল্পটা?
প্রযোজক জাহাঙ্গীর খানের ‘ডিস্কো ডান্সার’র সঙ্গে আমার ও বাবার ‘তুমি আমার’ মুক্তি পেল- সুপারডুপার হিট করলো। আমাকে জাহাঙ্গীর আংকেল আরও স্ক্রিপ্ট লেখার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি তখন পরিচালক হওয়ার বাসনার কথা বললাম। ওনার পরামর্শে আকবর (মনতাজুর রহমান) কাকার সঙ্গে তিন বছর সহকারী হিসেবে কাজ করি। তার সঙ্গে থেকে ‘বাবার আদেশ’, ‘শয়তান মানুষ’সহ বেশকিছু ছবির স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং সহকারী হিসেবে কাজ করলাম।

বাংলাদেশের প্রথম ছবি থেকে শুরু করে সবই তো নকল। হ্যাঁ, হয়তো ‘মুখ ও মুখোশ’ আমাদের সমাজ থেকে গল্প নেওয়া। আমার বাবারা তখন কোণঠাসা হয়েছিল, কারণ তারা সাহিত্য নিয়ে ছবি বানায় বলে- তাদের দিয়ে বাণিজ্য হবে না।
পরে পরিচালক হিসেবে কাজ করলেন না কেন? অর্থনৈতিকভাবে কম লাভবান হবেন তাই?
সেটা একটা ব্যাপার তো ছিলই। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে একজন পরিচালক এক বছরে ৩০০-৩৫০দিন একটা ছবির পেছনে কাজ করে। বিনিমিয়ে কত পায়? ৩-৪ লাখ! খুব বেশি হলে ৬ লাখ। এছাড়া এখানে একজন পরিচালক ছাড়া অধিকাংশ লোক জানে না কীভাবে কাজটা করতে হয়। আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করায় কথার অর্ধেক জুড়ে থাকতো ইংরেজি। আমার কথা ১৯৯৭-এর আগে কেউ বুঝতো না মিয়া। এই যে ‘মিয়া’ শব্দটি- এরকম কোনও স্ল্যাং আমি কখনওই ব্যবহার করতে জানতাম না। শিখতে হয়েছে। আমাদের এখানে দু-একজন পরিচালক ছাড়া কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। আপনার বুঝতে হবে তো, কার সঙ্গে কাজ করছেন? বুঝলাম। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলাম- এত নিচে নামা সম্ভব না। তাই ক্যামেরাম্যান লাল মোহাম্মদের পরামর্শে পরিচালনার স্বপ্ন বাদ দিয়ে আকবর কাকার বাইরেও স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করলাম। রীতিমতো গায়েপড়ে কাজ নিলাম ‘বিচ্ছু বাহিনী’ আর ‘রানী কেন ডাকাত’ ছবির।

ব্যস্ততা বাড়ল কখন থেকে?
১৯৯৭ সালে ‘রানী কেন ডাকাত’ ছবি থেকে। সবাই ভাবত জহিরুল হকের ছেলে ক্ল্যাসিক ছবি ছাড়া লিখতে পারবে না। কিন্তু ছবিটি মুক্তির পরে সবার সব ভয় কেটে গেল। কমার্শিয়াল লো বাজেটের সব মুভি আসতে থাকলো আমার কাছে। যেগুলোর বাজেট ছিল ৩০ লাখ টাকা। ১৯ লাখ শ্যুটিং বাজেট। আর ১১লাখ এফডিসির বিল। যদিও এক-দেড় কোটি টাকার ছবিও হতো তখন।

এই সাক্ষাতকারের প্রতিক্রিয়া পড়ুন
# বাবু ভাই আমি দুঃখিত, আপনার কথা মানতে পারলাম না # আবদুল্লাহ জহির বাবু, আমরা কিন্তু আসল-নকল চিনি
তার মানে বাবার মৃত্যুর সূত্রধরে একরকম হুট করেই আপনার এ পেশায় আসা?
জীবনে কখনও ভাবিনি। আমার ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত রুটিন ছিল ঘুম থেকে উঠে ক্লাশে যাব। সেখান থেকে ফিরে বিকালে গল্পের বই পড়ব। রাতে কয়েক ঘণ্টা পড়ে আবার ঘুম। ইন্টারমিডিয়েটের পরে আব্বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরতে পাঠালেন- জীবন কেমন হয় তা জানার জন্য। ভারতের বাবরি মসজিদের ‘ক্যাওয়াজ’ লাগায় বাবা আর ভারতে পড়তে যেতে দিলেন না সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় সিটি কলেজে পদার্থবিদ্যায় অনার্সে ভর্তি হলাম। পরে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করলাম।

নকলের ব্যাপারটা কি প্রথম থেকেই করতেন? নাকি পরিচালক-প্রযোজকদের চাপে পড়ে…
চাপ-টাপ বাজে কথা। বাংলাদেশের প্রথম ছবি থেকে শুরু করে সবই তো নকল। হ্যাঁ, হয়তো ‘মুখ ও মুখোশ’ আমাদের সমাজ থেকে গল্প নেওয়া। আমার বাবারা তখন কোণঠাসা হয়েছিল, কারণ তারা সাহিত্য নিয়ে ছবি বানায় বলে- তাদের দিয়ে বাণিজ্য হবে না। আপনি কি জানেন, আমার বাবাদের কাছে লোক কম আসত। কারণ তিনি ভালো মানুষ- মদ খায় না, ফুর্তি করে না। নকল বাংলাদেশে ঢুকছে কাজী জহিরের আমল থেকে। ‘দুলহান’ ভেঙ্গে ‘চিঠি আসবে আসবে’ গানটা ছিল যে ছবিটা ওটা- নামটা মনে পড়ছে না। বাবুল চৌধুরীর সুপার ডুপার হিট ‘সেতু’ হিন্দি ‘দিওয়ার’র নকল। ‘দোস্ত দুশমন’ বানিয়েছে দেওয়ান নজরুল, ‘শোলে’র নকল। ‘জনি’ বানিয়েছে ‘জনি মেরা নাম’ থেকে। ভারত গিয়ে বড় টেপ রেকর্ডারে সংলাপ, শটসহ ভয়েস রেকর্ড করে নিয়ে আসতো। এখন হিরোর এন্ট্রি, এখন নায়িকার ইমোশন, মুভমেন্ট শট- পজ করে করে রেকর্ড। দেশে এসে শুনে তৈরি হতো স্ক্রিপ্ট।

আমরা টু-কপি ছবি কখনও সাপোর্ট করতাম না। এমনকি কাটপিসের আমলেও হয় নাই। আমাদের দেশের বড় বড় পরিচালক এফ আই মানিক, সোহানুর রহমান সোহানরা এক্কেবারে ‘শর্ট টু শর্ট’ কার্বন কপি ছবি বানাতে শুরু করলেন।
কিন্তু হলে বসে বসে কীভাবে এটা করত? হল কর্তৃপক্ষ কিছু বলতো না বা দেখতো না ব্যাপারটা?
সিনেমা হলে তো সব শোতে লোক হয় না। বিশেষ করে সকালের শোতে বন্ধের দিন ছাড়া তো হয়ই না। প্রতিদিন সকালের শোতে হলে ঢুকে এক সপ্তাহ ধরে কাজটা করা হতো।

আপনার করা প্রথম নকল ছবি কোনটি- সরাসরিই প্রশ্ন করলাম।
(মনতাজুর রহমান) আকবর কাকার ‘বাবার আদেশ’। ‘গার্দিস’ এর নকল ছিল। এটা আমাকে কাকার প্রোডাকশন হাউজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল।

আপনার লেখা মৌলিক ছবি আছে কি?
থাকবে না কেন? ‘বিচ্চু বাহিনী’, ‘রাণী কেন ডাকাত’ থেকে শুরু করে হালের ‘দবির সাহেবের সংসার’ কিংবা এখন লিখছি ‘নিয়তি’। তবে, আমরা টু-কপি ছবি কখনও সাপোর্ট করতাম না। এমনকি কাটপিসের আমলেও হয় নাই। আমাদের দেশের বড় বড় পরিচালক এফ আই মানিক, সোহানুর রহমান সোহানরা এক্কেবারে ‘শর্ট টু শর্ট’ কার্বন কপি ছবি বানাতে শুরু করলেন। কাজী হায়াতের ‘বর্তমান’ সঞ্জয় দত্তের এক ছবি থেকে নেওয়া। আমার প্রথম বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া ছবি ‘মুখোমুখি’। ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’ ফ্রেম টু ফ্রেম কপি করলাম ‘লাগলা’ থেকে। মান্না ভাই করতে চাইলেন না- কারণ শাবনূর ও অমিত হাসানকে একই গল্পে ছবি হয়ে গেছে। এছাড়া আকবর কাকা ‘বশিরা’ ছবির রাণী চরিত্রটি ওই গল্প থেকে ধার করেছিলেন। আমার জোরাজুরিতে কাজটা হলো- ফলাফল সুপার ডুপার হিট।

এই যে নকল করছেন এ নিয়ে কখনও খারাপ লাগে না? কিংবা কখনও নিজে প্রতিবাদ করেন নাই?
না না। সেন্সর বোর্ডের একটা ধারা আছে- ‘নকল ছবি সেন্সর দেওয়া যাবে না।’ নকল তো ভাই ক্রাইম না। আপনি দরজা খুলে রেখেছেন। আপনার বাসায় ঢুকে আমি কিছু নিয়ে গেলাম- আপনি কিছু না বলা পর্যন্ত আমি চোর না। পৃথিবীর কোনও আদালত আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না। এখন যদি ২০ কোটির ছবি ৭০ লাখে বানায় বানাক না ভাই।

৭০ লাখে কি ২০ কোটির মানটা থাকছে?
অবশ্যই থাকছে না- খুব ভালো করেই জানি। বদিউল আলম খোকনের মত অন্য ছবির সিন কেটে এনে বসিয়ে দেওয়া তো হচ্ছে না। আমাদের এডিটর জিন্না ভাইয়ের ফর্মুলা এটা- যেহেতু শ্যুট করতে পারবো না, কেটে এনে সোজা বসিয়ে দাও! এই তো চলছে।

কপিরাইট এনে কাজটা করলে তো এই সমালোচনাটা থাকে না। সেটা হচ্ছে না কেন?
বাংলাদেশে আমার মতো এত কপিরাইট কেউ কিনে নাই- আমাকে ‘কপিরাইট মাস্টার’ বলতে পারেন। কপিরাইটের মূল্য সর্বনিম্ন ২হাজার ডলার। সম্পূর্ণ নতুন ছবি হলে ১০হাজার ডলার পর্যন্ত লাগে। সর্বশেষ এনেছি ‘হিটম্যান’ এর জন্য। ওখানাকার প্রযোজক এমএলএ চৌধুরী পারলে আমাকে মারে- যখন আমি বলেছি আমাদের ছবির বাজেট সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সে আমাকে তখন মিথ্যাবাদী ভেবেছে- কারণ তাদের একটা গানের বাজেটই এর বেশি থাকে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো জাজের প্রতিটা ছবি কপিরাইট এনে বানানো।

আমার লেখা নকল ছবি ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’। এমন ছবি কেন হবে না। আমাকে নিয়ে মান্না ভাই ছবি মুক্তির ছয় মাস পরে চার কোটি টাকা এফডিআর করছে তার ছেলের নামে। নকল ঠ্যাকাবেন কী দিয়ে?
অন্যের কাহিনী নিজের নামে চালিয়ে দিতে কোনও সংকোচবোধ করে না? এতে তো আপনার নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সেটা তো আমার সমস্যা, অন্য কারও না। আমি না যদি বলি আপনি জানবেন কোথা থেকে? আমি সম্প্রতি কোরিয়ান ছবি থেকে স্ক্রিপ্ট কপি করছি। সর্বশেষ গল্পটা করছি নাইজেরিয়ান একটি ছবি থেকে। তো…

তথ্য প্রযুক্তির এ সহজলভ্যতার যুগে কেউ না কেউ তো ধরে ফেলছে এসব?
ধরুক। আপনি এটাকে ক্রাইম কেন বলছেন বারবার! সেন্সর বোর্ডের একটা নিয়মের জন্য? এখন পর্যন্ত শুনেছেন- নকল ছবি চলে নাই? অথচ নকল ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ‘কুত্তা হিট’ ছবি।

ওটাতো কপিরাইট আনা ছবি।
কেউ দেখাতে পারলে আমি *** হয়ে রাস্তায় নাচবো। কেউ কি এই ছবির কপিরাইট নিয়ে আজও চ্যালেঞ্জ করেছে? আমার লেখা নকল ছবি ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’। এমন ছবি কেন হবে না। আমাকে নিয়ে মান্না ভাই ছবি মুক্তির ছয় মাস পরে চার কোটি টাকা এফডিআর করছে তার ছেলের নামে। নকল ঠ্যাকাবেন কী দিয়ে?

তবুও প্রশ্ন- খালি তামিল-তেলেগু ছবির গল্প কেন নকল করতে হবে?
কেননা হিন্দিতে কোনও গল্প নেই। তামিলরা গল্প সবচেয়ে বেশি রিসার্চ করে। মাদার ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রি ভারতে। তারা বছরে ২০টি ছবি করে- যেগুলো সব মৌলিক গল্পের। এগুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগে বলিউড ও তামিল ইন্ডাস্ট্রির মাঝে।

আমার প্রযোজক মিস হয় না কেন জানেন? আমি গল্প বলার আগে তাকে মাপি। তার সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক সামর্থ্য, সে কেন এসেছে প্রযোজনা করতে- এসব মিলিয়ে একটা টার্গেট তৈরি করি। যার ফলে তার রুচি অনুযায়ী আমি গল্প শোনাই- ফলে আমার কোনও সিটিং মিস হয় না।
অন্যদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একটা স্বকীয়তা তৈরি করেছে। অথচ আমাদের তা নেই- এভাবে নকল চললে তা কীভাবে হবে?
সারা পৃথিবীতে এমন কোনও স্বকীয়তা আছে কি? হলিউড, বলিউড, তামিল, তেলেগু, নাইজেরিয়ান সব ছবিতে ‘বাবার হত্যার প্রতিশোধ’ আছে। ‘বাংলাদেশি ফিল্ম’ বলে কোনও শব্দ নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভুয়া কথা এটা।

আপনাকে নিয়ে বাজারে প্রচলিত মিথ- নতুন পরিচালক কিছু না জানলেও চলে, আপনার কাছে এলেই ছবির সব কিছু হয়ে যায়। এটা কি মিথ নাকি সত্যি ঘটনা?
আমাদের দেশের নতুন যারা পরিচালক তাদের আসলে ওইভাবে স্কুলিংটা নেই কিভাবে একজন প্রযোজক ম্যানেজ করতে হবে। আমার প্রযোজক মিস হয় না কেন জানেন? আমি গল্প বলার আগে তাকে মাপি। তার সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ড, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক সামর্থ্য, সে কেন এসেছে প্রযোজনা করতে- এসব মিলিয়ে একটা টার্গেট তৈরি করি। যার ফলে তার রুচি অনুযায়ী আমি গল্প শোনাই- ফলে আমার কোনও সিটিং মিস হয় না। এটা শিখতে আমাকে ১৯৯৯ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে- ভুলে যেতে হয়েছে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা।

আউটডোর এমন জায়গা যেখানে আপনিই রাজা- যেখানে আপনি যা খুশি করতে পারেন। আপনি কার সঙ্গে প্রেম করছেন কিংবা কোথায় ঘুরছেন কেউ আপনাকে কিছু বলার নেই।
মানে কী দাঁড়ালো? খুলে বলবেন কি?
আমাকে কেন জানতে হবে পূর্ণিমা ম্যাডামের শরীর কখন খারাপ কিংবা অঞ্জু ঘোষ কখন কলকাতা থেকে ঢাকা আসবেন? ’৯৯তে এই অঙ্গনে সরাসরি পা রেখে বুঝলাম এটা ছাড়া তো চলবে না। ২০০০ সালে ‘শিকারী’ ছবির আউটডোরে গেলাম জাস্ট পূর্ণিমা ম্যাডামের ক্লোজ হবার জন্য। তখন মনে মনে বললাম- ও! এটা তাহলে আউটডোর! আউটডোর এমন জায়গা যেখানে আপনিই রাজা- যেখানে আপনি যা খুশি করতে পারেন। আপনি কার সঙ্গে প্রেম করছেন কিংবা কোথায় ঘুরছেন কেউ আপনাকে কিছু বলার নেই।

গুঞ্জন রয়েছে প্রযোজকদের ম্যানেজ করার জন্য আপনি নায়িকাদের ‘ইশারা’ কাজে লাগান!
আমি কখনওই দালালি করি না। কখনওই কোনও নায়িকাকে বলি না ‘ওমুককে সময় দাও’। এটা আমার কাজ না। এটা সম্পূর্ণ তাদের বিষয়। আমি একটা ছবির স্ক্রিপ্ট হতে টোটাল ম্যানেজমেন্টের কাজটা করে থাকি। আমি এটা করি যাতে একজন প্রযোজক একটা ছবি করেই হারিয়ে না যান।
আর পুরো পৃথিবীটা গ্ল্যামারের পাগল। গ্ল্যামার তো খালি নারীদের থাকে না। ইলিয়াস কাঞ্চন না থাকলে সন্ধানী কথাচিত্রের মালিক সিনেমাতেই আসতো না। যে ক্যাটরিনা কাইফকে দেখার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে থাকে। তাকে যদি ১০০কোটি খরচ করে সিনেমা বানিয়ে এক মাস খালি সামনাসামনি দেখা যায়, তাহলে যার টাকা আছে সে কেন করবে না?

আপনি তামিল-তেলেগু ছবির গল্প নিয়মিত অনুবাদ করান কিছু ভাড়াটে লোক দিয়ে। বিনিময়ে অর্থ দেন। আর নামটা যায় আপনার। কতটা সত্য-মিথ্যে?
পুরোটাই সত্যি। আগে কিছু লোক ছিলো যাদের জন্মই তামিলনাড়ুতে। তারা বাংলায় অনুবাদ করতো- লিখে বা রেকর্ড করে নিয়ে আসতাম। এখন ইন্টারনেটের যুগে তা লাগে না। তারপরেও হবহু কপি ছবি হলে যেসব ছেলে মেয়ে কাজ খুঁজে তাদের একটা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কেনার টাকা দিয়ে ছবি অনুবাদ করতে দিই। অনুবাদের বিনিময়ে আবার তাদেরকে টাকাও দিই।

শিল্পীদের শিডিউল ম্যানেজ করে দেওয়ার বিনিময়ে অর্থ নেওয়ার অভিযোগও আছে…
আস্তাগফিরুল্লাহ। আরে আমি মাহি আর বাপ্পির শিডিউল মাঝে ঠিক করে দিতাম জাজের কর্ণধার আজিজ ভাইয়ের অনুরোধে। হয়েছে কী, বাপ্পি না বুঝে একসঙ্গে ১৩টা ছবি সাইন করে ফেলেছিল। তখন আমি সবকিছু ঠিক করে দিলাম। আর মাহিরটাও জানতে হয়েছিল অন্যদের শিডিউল মিলেয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু টাকা নেওয়ার ঘটনা আপনার কাছে প্রথম শুনলাম।

অভিযোগ নয়, এটাই সত্যি-নিজের চিত্রনাট্যের বাইরে অন্য কোনও ছবি ব্যবসা না করলে আপনি সরাসরি ছবিটির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি শুরু করেন। এটা কেন করেন?
(কিছুটা উত্তেজিত স্বরে) সবাই বলে আমার ছবি ফ্লপ, আমার ছবি নকল- কোনও সমস্যা নেই এতে। বলতেই পারেন- ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘আজব প্রেম’ ঐতিহাসিক ফ্লপ। সমস্যাটা হলো মিডিয়া (টিভি) থেকে যারা আসেন তারা আগেই বলে ফেলেন- উল্টায়া ফেলবেন ইন্ডাস্ট্রি, আর বানাবেন ‘তারকাঁটা’। আরে ব্যাটা(নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ এর উদ্দেশ্যে) ‘তারকাঁটা’ মানে পেরেক। এইটা তো তোমাকে বুঝতে হবে। আর ছবির গল্প অনুযায়ী একটা ছেলে কাঁটা তারের বেড়ায় বন্ধি- বোন, প্রেমিকা, নিজের জীবন সব মিলিয়ে। তাহলে তো নাম হয় ‘কাঁটাতার’। আমি এসব বলতে গেলেই দোষ! আপনি তাদের ছবি মুক্তির আগে স্ট্যাটাসগুলো দেখেন- কী লিখেছিল তারা।

অভিযোগ রয়েছে যদি তারা আপনার কাছ থেকে স্ক্রিপ্ট নিতেন তাহলে এমন কথা ভুলেও বলতেন না।
দেখেন আমি বড়াই করা পছন্দ করি না। আপনি সিনেমা বানানোর আগে বড় বড় লেকচার না দিয়ে আমাকে বলতেই পারেন- বাবু ভাই আমাকে একটু সাহায্য করেন। আপনি আমাকে খাটায়ে কোনও টাকা না দেন, নাম না দেন- যদি তা অন্যের করা স্ক্রিপ্ট হয়। এখন যে লোকগুলো ‘তারকাঁটা’ দেখতে গিয়ে গালি দিয়ে হল থেকে বের হয়েছে, সে লোকগুলোকে আপনি কিভাবে আবার হলে নিবেন? আমার দুঃখ তো সেখানে।

তাহলে যারা এফডিসি থেকে আসেন নাই- তারা ছবি বানাতে পারবে না। আপনি কি তা-ই বলতে চাইছেন?
না, অবশ্যই আসবে। তাদের অবশ্যই কোনও পরিচালকের সঙ্গে থেকে ২-৩ বছর কাজটা শিখতে হবে। তাদের বুঝতে হবে মানুষের মন, টার্গেট অডিয়েন্স কোনটা। একটা স্টার সিনেপ্লেক্স দিয়ে সারাদেশ বিবেচনা করলে তো চলবে না।

আপনি তো এই ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র লোক- অন্যদের, তরুণদের এভাবে পাবলিকলি বলাটা কি ঠিক হচ্ছে?
কেন ভাই সমস্যাটা কী? আমি তো ওপেনলি প্রশংসাও করেছি- ‘জিরো ডিগ্রি’ ও ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ এর। বলেছিলাম মফস্বলের বাইরের হলে চলবে না- চলে নাই। বলছিলাম ৫০ লাখের বেশি কামাবে না। এক প্রযোজকের সাথে বাজি লাগছিলাম- হেরে গিয়ে উনি আর এখন আমার সঙ্গে কথাই বলে না। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ দেখে আমার মনে হয়েছে একটা সিনেমা দেখেছি। কিছু ভুল ত্রুটিতো ছিল। আরে মিয়া আমাদের ছবিতেও তো ভুল ত্রুটি থাকে। যেমন আমাদের ‘আশিকী’ দেখেতো আমারই ভালো লাগে নাই। আমি তো কখনওই কাউকে জমা-খরচ করে কথা বলিনি। অথচ ‘তারকাঁটা’ই আপনার পায়ে বিঁধেছে!

হয়তোবা। এফডিসি কিংবা মিডিয়া- এ বিভাজনটা কেমন না? সবাই ফিল্মের লোক এটা মেনে নিতে সমস্যা কী?
সবাই ফিল্মের লোক কিভাবে হবে! ফিল্ম বানালে, ফিল্ম বানানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকলে। রাইট? কিন্তু যারা আসছে- তাদের এ নিয়ে কোনও আইডিয়াই নেই। সব নাটক, টেলিফিল্ম হচ্ছে।

বাবা সবসময় বলতেন- সামনে যা পাবি সব পড়বি। ভাল লাগলে আবার পড়বি। এখন ফিল্ম ডিরেক্টর ব্যাপারটারে আমরা ফালতু করে ফেলছি। এখনও অনেক পরিচালক আছে যারা মেট্রিক পাশই করে নাই, কোনও সাহিত্যই পড়ে নাই
তাহলে কি আপনি বলতে চান- পাঁচটা গান, দুটা ফাইট আর তামিল একটা গল্প হলেই সিনেমা হবে, না হলে হবে না?
গুষ্টি কিলাই ভাই। গান ছাড়াও ফিল্ম হয়। এখন ‘রানআউট’-এ ভালো এলিমেন্ট ছিলো- কিন্তু চলে নাই। যদি ভাল কাউকে স্ক্রিপ্টটা দেখাইতো আর এডিটিংটা করাতো তাহলে এ সমস্যাটা হতো না। এটা কে কাকে বুঝাবে?

আপনার বাবার আমলে সাহিত্য নির্ভর ছবি হতো প্রচুর। আপনি চাইলে তো সাহিত্য থেকে গল্প নিতে পারেন। সেটা তো নিচ্ছেন না।
হতো। কারণ, ওই সময় যারা বিনিয়োগকারী ছিলেন তারা শিক্ষিত, সাহিত্য পড়া শিল্প অনুরাগী লোক ছিলেন। এখন যারা আসছেন তারা কোন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছেন? তাদের বাসায় কি নাটক হতো, তিনি নিজে নাটক করতেন? ‘মুভি মোঘল’খ্যাত জাহাঙ্গীর খান ১২ বছর বয়স থেকে বাসা থেকে পালিয়ে সিনেমা দেখতেন। আমার বাবা ১৮ বছর বয়স থেকে পরিচালনা করেন। আমাদের পড়ার অভ্যাস উনি গড়ে দিয়েছেন- চার আলমারী ভর্তি বই ছিল। স্কুল শেষ করার আগে আমি রবীন্দ্রনাথ, শীর্ষেন্দু, শরৎ, শালর্ক হোমস, ম্যাক্সিম গোর্কি সব পড়ে শেষ করেছি। কারণ বাবা সবসময় বলতেন- সামনে যা পাবি সব পড়বি। ভাল লাগলে আবার পড়বি। এখন ফিল্ম ডিরেক্টর ব্যাপারটারে আমরা ফালতু করে ফেলছি। এখনও অনেক পরিচালক আছে যারা মেট্রিক পাশই করে নাই, কোনও সাহিত্যই পড়ে নাই। তাহলে কেমনে হবে? ফিল্ম যদি আপনার মননে ধারণ না করেন তাহলে কোনদিনই হবে না।

হয়তোবা হ্যঁ, নয়তোবা না। দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রাণখুলে কথা বলাবার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
এসব জানতে চায় না কেউ। বাংলা ট্রিবিউন আমার কথা জানতে চেয়েছে, এরজন্য ধন্যবাদ।